৩.১.২.২ ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগসমূহ:
(ক) সালমোনেলোসিস (Salmonellosis)
সালমোনেলা গোত্রের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট মুরগির রোগগুলোকে সালমোনেলোসিস বলে। যে কোনো বয়সের মুরগিই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তবে ১ দিন হতে ২ সপ্তাহ বয়সের বাচ্চা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। প্রধানত ডিমের মাধ্যমে বাচ্চাতে এ রোগ বিস্তার লাভ করে । মৃত্যুহার ১০০% পর্যন্ত হতে পারে। সালমোনেলা গুলোরাম নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা রোগটি হলে একে পুলোরাম রোগ বলে। সালমোনেলা গ্যালিলেরাম নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা রোগটি হলে একে ফাউল টাইফয়েড রোগ বলে।
রোগের লক্ষণ:
- মুরগির বাচ্চার পাছা ভিজা থাকবে ও হলদে বর্ণের পাতলা পায়খানা করবে।
- বাচ্চা চি চি শব্দ করবে এবং মাথা একদিকে করে তাপের কাছে জমা হবে।
- পাখা এলোমেলো হবে, চুপচাপ বসে ঝিমাবে ।
- খাবারের প্রতি অনীহা থাকবে।
- তীব্র পানি শুন্যতার কারণে মুরগি মারা যায়।
- মৃত বাচ্চার উদর গহ্বরে ডিমের কুসুম লেগে থাকে ।
- বাড়ন্ত মুরগিতে খোঁড়া পা ও হাড়ের জয়েন্ট ফুলে উঠার কারণে বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
- মুরগির এক ভায়েন্ট ফুলে যায় ও খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে।
- ঝুঁটি সাদা হয়ে যায়।
পোস্টমর্টেম লক্ষণ:
বাচ্চাতে কুসুম অশোষিত অবস্থায় থেকে যায়। বিকৃত ও বিবর্ণ ডিম দেখতে পাওয়া যায়।
প্রতিরোধ:
- বায়োসিকিউরিটি বজায় রাখতে হবে।
- বাহক মুরগি নিধন করতে হবে সালমোনেলা যুক্ত বাচ্চা দ্বারা খামার শুরু করতে হবে।
- নিয়মিত আইওসান মিশ্রিত পানি দ্বারা ঘর, খাবার পাত্র ও পানির পাত্র পরিষ্কার করতে হবে ।
চিকিৎসা:
ইএসবি ৩০% পাউডার বা কসুমিক্স প্লাস ১ লিটার পানিতে ১-২ গ্রাম মিশিয়ে ৩-৪ দিন খাওয়াতে হবে। এছাড়া প্রতিদিন স্যালাইন খাওয়াতে হবে। শুধু অ্যান্টিবায়োটিক সালমোনেলা দূর করা সম্ভব নয়। সালমোনেলা কিলার (যেমন: বায়োট্ৰনিক এস ই) নিয়মিত ব্যবহারে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
(খ) সংক্রামক সর্দি (Infectious Coryza)
সংক্রামক সর্দি বা ইনফেকশাস করাইজা মুরগির শ্বাসতন্ত্রের এর একটি মারাত্বক ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ। সব বয়সের মুরগি এতে আক্রান্ত হলেও সাধাণত বয়স্ক মুরগি বেশি আক্রান্ত হয়। মুরগির মুখমণ্ডল ফুলে যাওয়া এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ রোগকে ঠান্ডা লাগা, আনকমপ্লিকেটেড করাইজাও বলে। এ রোগ ১০০% পাখি আক্রান্ত হতে পারে, তবে মৃত্যু হার আনুপাতিক হারে অনেক কম।
রোগের কারণ:
হিমোফিলাস গ্যালিনেরাম নামক এক প্রকার ক্ষুদ্র দণ্ডাকৃতির বা কক্রোব্যাসিলাই ব্যাকটেরিয়ার এ. বি. ও . টাইপ এ রোগ সৃষ্টি করে ।
সংক্রমণ পদ্ধতি:
নিম্নলিখিতভাবে এ রোগ সুস্থ পাখিতে সংক্রমিত হয়। যথা-
- আক্রান্ত মুরগি সুস্থ মুরগির সংস্পর্শে আসলে।
- কলুষিত শ্লেম্মার যারা দুষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ।
- পাশাপাশি অবস্থিত মুরগির ঘরে বাতাসের মাধ্যমে এ রোগের জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে।
রোগের লক্ষণ:
করাইজা রোগে আক্রান্ত মুরগিতে নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা যায়। যথা:
- মুখমণ্ডল ও মাথা ফুলে যায় ।
- নাকমুখ দিয়ে পানি ঝরে।
- অক্ষিঝিল্লির প্রদাহ হয়ে চোখ ফুলে যায় ও আঠাযুক্ত হয়।
- পলার ফুল বিবর্ণ হয়ে যায় ও ফুলে ওঠে।
- খাদ্য ও পানি পান করা বন্ধ হয়ে যায়।
- নাক দিয়ে শ্লেষ্মা করে।
- কাঁশি হয় ও গলা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ বেরোয়।
- শ্বাসকষ্ট হয়।
- ডিমপাড়া মুরগির ডিম উৎপাদন হ্রাস পায়।
- লক্ষণ প্রকাশের ২-৩ দিনের মধ্যেই আক্রান্ত পাখি মারা যেতে পারে।
রোগ নির্ণয়:
- রোগের ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ দেখে।
- নাকের ঝিল্লিপর্দা ও সাইনাসের শ্লৈষ্মিক প্রদাহ থাকে।
- অক্ষিঝিল্লির প্রদাহ, মুখমণ্ডল ও গলার ফোলা থাকে।
সংক্রামক সর্দি বা ইনফেকশাস করাইজার চিকিৎসা:
- খাদ্যের সঙ্গে সালফাডাইমিথোক্সিন ও সালফাথায়জল ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে। প্রয়োজনে পুনঃচিকিৎসা দিতে হবে ।
- তাড়াতাড়ি সুফল পেতে হলে ভেটেরিনারি সার্জনের নির্দেশিত মাত্রায় স্ট্রেপটোমাইসিন ইনজেকশন ও খাদ্যের সঙ্গে সালফোনেমাইড ওষুধ খাওয়াতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ :
নিম্নলিখিতভাবে সংক্রামক করাইজা রোগ প্রতিরোধ করা যায়। যথা-
- খামারে স্বাস্থ্যসম্মত বিধিব্যবস্থা মেনে চলতে হবে ।
- যেহেতু এ রোগ থেকে সেরে ওঠা পাখি রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে তাই পালনের জন্য বয়স্ক মুরগি না কিনে একদিন বয়সের বাচ্চা কেনা উচিত ৷
- টিকার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। এজন্য ইনঅ্যাকটিভেটেড ইনফেকশাস করাইজা টিকা ব্যবহার করা। নেদারল্যান্ডের ইন্টারভেট কোম্পানি কর্তৃক প্রস্তুত এ টিকার নাম নভিভ্যাক করাইজা। প্রতিটি পাখির পেশি বা ত্বকের নিচে ০.৫ মি.লি. মাত্রায় টিকা প্রয়োগ করা হয়। প্রথমবার ৬ সপ্তাহ বয়সে ও দ্বিতীয়বার ৮ সপ্তাহ বয়সে টিকা প্রদান করলে ৮ মাস পর্যন্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়। বাংলাদেশে করাইজার কোনো টিকা প্রস্তুত হয় না ।
(গ) নেক্রোটিক এন্টারাইটিস (Necrotic enteritis)
এন্টারাইটিস কথাটির অর্থ হলো অস্ত্রের প্রদাহ। নানা কারণে অন্ত্রে প্রদাহ হতে পারে। অস্ত্রে উত্তেজক পদার্থের উপস্থিতি বা বিভিন্ন জীবাণু ও পরজীবীর কারণে এন্টারাইটিস হয়। সাধারণত ২-৮ সপ্তাহ বয়সের মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হয়, তবে ১(এক) সপ্তাহ বয়সের বাচ্চাও আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগে মৃত্যুর হার ৫-৫০% পর্যন্ত হতে পারে।
নেক্রোটিক এন্টারাইটিস রোগের কারণ:
বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, (যেমন: সালমোনেরা, ই-কলাই ও ক্লোস্ট্রিডিয়াম পারপ্রিনজেনস) ও প্রোটোজোয়া(ককসিডিয়া) এ রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী ।
রোগের লক্ষণ:
- আক্রান্ত মোরগ-মুরগি ভীষণ নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
- প্রচন্ড ডায়রিয়া দেখা দেয়, লক্ষণ প্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যেই অবস্থার দ্রুত অবনতি হয় এবং শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মৃত্যু হয়।
- অনেক সময় লাল রঙের গুড়ের মতো বিষ্ঠা হয় বা কক্সিডিওসিস বা রক্ত আমাশর হিসাবে ভুল হতে পারে।
- তাছাড়া অনেক সময় পানির মত পাতলা বিষ্ঠা হয় এবং বদ হজমকৃত খাদ্য বিষ্ঠা সাথে বেরিয়ে আসতে পারে।
- মোরগ-মুরগির ডানা ঝুলে পড়ে, দাঁড়াতে পারে না।
- পালক উস্কো-খুস্কো হয়ে যায় ।
- ঠোঁট দিয়ে লালা পড়ে।
- বুকের মাংস কালো হয়ে যায়।
পোস্টমর্টেম লক্ষণ:
কলিজা বড় হয়ে যায়, হলুদাভ রং এর এবং রক্তক্ষরণ দেখা দেয়। অস্ত্রে রক্তক্ষরণ হয় এবং গ্যাস জমে বেলুনের মতো ফুলে উঠে। অনেক সময় ক্ষুদ্রান্তে সাদা রঙের ঘা দেখা দেয়। ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রাচীর মোটা হয়ে যেতে পারে।
রোগ প্রতিরোধঃ-
বায়োসিকিউরিটি মেনে চলতে হবে। সংক্রমিত ঘর ও সরঞ্জাম ১:২০০ বা ১:৫০০ কস্টিক সোডা মিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
- ভাইরাস: ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদানের মাধ্যমে ভাইরাসজনিত রোগ দমন করা হয়।
- প্রোটোজোয়া: কক্সিডিয়া নামক প্রটোজোয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পোল্ট্রি খাদ্যে কক্সিডিয়া বিরোধী ঔষধ ও ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়।
- ব্যাকটেরিয়া: এন্টারাইটিস সৃষ্টিকারী ২ ধরনের ব্যাকটেরিয়া আছে-
(ক) সালমোনেলা, ই. কলাই ইত্যাদি গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া- খাদ্যে বিভিন্ন এসিডিফায়ার (সালমোনেলা কিলার), এন্টিবায়োটিক (সি.টি.সি./অক্সি-টেট্রাসাইক্লিন/ফুরাজলিডন/টাইলোসিন ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
(খ) ক্লস্ট্রিডিয়াম পারফ্রিনজেনস (Clostridium perfringens) : নামক গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্টি নেক্রোটিক এন্টাররাইটিস রোগটি দমনের জন্য আমরা কার্যকর তেমন কিছু ব্যবহার করি না। নেক্রোটিক এন্টারাইটিস যেকোনো বয়সের মোরগ-মুরগির হতে পারে। মৃত্যুহার লেয়ার মুরগির তুলনায় ব্রয়লার মুরগির বেশি। রোগটির সংক্রমণ কোনোরূপ পূর্ব লক্ষণ প্রকাশ না করেই ঘটতে পারে। পুরাতন লিটার পুনঃব্যবহার করলে রোগটি ছড়াতে পারে। পুরাতন লিটারের মধ্যে রোগটির স্পোর বা বীজ থাকার সম্ভাবনা বেশি।
চিকিৎসা:
যেকোনো অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন- টেট্রাসাইক্লিন বা রেনামাইসিন এর যেকোনো একটি ঔষধ বিধি মোতাবেক পানির সাথে খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়।
(ঘ) কলিবেসিলোসিস (Colibacillosis)
ইসকারিসিয়া কলাই নামক এক প্রকার ব্যাটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগসমূহকে কলিবেসিলোসিস রোগ বলে । এই জীবাণুটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম রোগ সৃষ্টি করতে পারে। সব প্রাণির শরীরের ভিতরে ও বাইরের পরিবেশে যেমন- খাদ্য বা পানির ভিতর এই জীবাণু উপস্থিত থাকে। সময় সুযোগমত জীবাণুটি শরীরের ভেতর রোগ সৃষ্টি করে । শরীরের অন্য কোনো রোগের উপস্থিতিতে বা অন্য কোনো ধরনের কারণে শরীর যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখনই এই জীবাণু রোগ সৃষ্টি করে । আবহাওয়াগত বা অন্য কোনো কারণে বাতাসের আর্দ্রতা বা লিটারের আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়
সংক্রমণের উপায়ঃ
- ডিম পাড়া মুরগির প্রজনন নালিতে জীবাণু বিদ্যমান থাকলে তা ডিমকে আক্রান্ত করতে পারে বা ঐ ডিম হতে যে বাচ্চা ফুটে তাকে সংক্রমিত করতে পারে।
- আক্রান্ত মুরগির সংস্পর্শে আসলে বা হাঁচি, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অন্য মুরগিতে ছড়াতে পারে ৷
- ইনকিউবেটরের আর্দ্রতা বেশি থাকলে এবং যন্ত্রপাতির মধ্যে এই রোগের জীবাণু বিদ্যমান থাকলে সদ্য ফোটা বাচ্চার রোগ দেখা দিতে পারে ।
- মোরগ-মুরগি স্থানাস্তর করার সময় পরিবহন বা অন্য কোনো ধকল পীড়নের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- ঘরের মধ্যে এমোনিয়া গ্যাস জমে গেলে যে পীড়ন সৃষ্টি হয় তার ফলেও মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
রোগের লক্ষণঃ
এ রোগের লক্ষণগুলো নির্ভর করে মুরগির কোনো অঙ্গে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে তার উপর। যেমনঃ
১. অম্ল প্রদাহ (Enteritis):
- পাতলা বিষ্ঠা হয়ে থাকে এবং পিছনের পালকে বিষ্টা লেগে থাকে।
- পালক উস্কো খুস্কো থাকে ।
২. কলিসেপটিসেমিয়া (Colisepticaemia):
- হঠাৎ করে মোরগ-মুরগি অসুস্থ হয়ে পড়ে ও নিস্তেজ হয়ে যায়। নড়চড়ায় অনীহাভাব প্রকাশ পায় ।
- মৃত্যু হার বেড়ে যায়। শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় ।
- শরীরের ভিতর বিভিন্ন অঙ্গে রক্তকরণ দেখা দেয়।
- ডিমের মাধ্যমে সংক্রমণ হলে ভ্রুণ মারা যায় বা বাচ্চা ফুটলেও রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং ৪- ৫ সপ্তাহ পর্যন্ত মৃত্যু হতে থাকে।
- যকৃতের মধ্যে সবুজ ক্ষত ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানার মতো দেখা যায় ।
৩. কলিগ্যানুলোমা (Coligranuloma):
- মুরগির যকৃত, অস্ত্র ইত্যাদির ঝিল্লীতে গুটিগুটি দানার মত দেখা যায় ।
৪. এয়ার স্যাক ডিজিজ (Air Sac Disease) :
- ৬-৭ সপ্তাহের ব্রয়লার মুরগিতে এ রোগের প্রকোপ দেখা যায়।
- শ্বাসনালী ও শ্বাস থলির মধ্যে এই ইনফেকশন হয় বলে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় ।
- হৃৎপিন্ড, যকৃত ও চোখে প্রদাহ দেখা দেয় ।
৫. প্যানঅপথ্যালমাইটিস ও সোলেন হেড ডিজিজ (Panonthalmitis & Swollen Head Disease):
- কলি সেপ্টিসেমিয়া রোগে আক্রান্ত মুরগির চোখের ভিতর ও তার চারিধারে দধির মত অথবা পুঁজ জাতীয় পদার্থ জমা হয় বলে চোখ ফুলে যায় ও চোখ বন্ধ করে রাখে। কখনও কখনও চোখ অন্ধ হয়ে যায় । এটাই প্যানঅপথ্যালমাইটিস নামে পরিচিত ।
- আবার দেখা যায় ব্রয়লার মুরগির চোখের চারিধারে পানি ও পুঁজ জমে ফুলে যায়। ফলে মনে হয় মাথা ফুলে গেছে। এটাকেই “সোলেন হেড ডিজিজ” বলে। এ সমস্ত মুরগি বার বার মাথা নাড়ে ও ঘাড় বাঁকিয়ে রাখে।
৬. চর্ম প্রদাহ (Dermatitis):
- চামড়ার নিচে জলপূর্ণ স্ফীতি ও মাংসপেশিতে রক্তক্ষরণ পরিলক্ষিত হয়।
- চামড়ার ঘা দেখা যেতে পারে ।
৭. সাইনোভাইটিস (Syovitis):
- রক্তের মাধ্যমে জীবাণু প্রবেশ করে হাড়ের জয়েন্ট বা অস্থি সন্ধিতে ইনফেকশন করে ।
- সাধারণত বাচ্চা মুরগি আক্রান্ত হয়। ফলে অস্থি সন্ধি বা গীড়া ফুলে যায় ও মুরগি হাঁটতে পারে না ।
৮. ওফ্যালাইটিস (Omphalitis):
- নাভীর প্রদাহে বাচ্চা দুর্বল হয়ে পড়ে।
- অপেক্ষাকৃত উষ্ণ স্থানে বাচ্চারা জড়ো হতে থাকার প্রবণতা দেখা যায় ।
- এই রোগে আক্রান্ত হলে বাচ্চার নাভীর ঘা শুকায় না এবং বাচ্চার মৃত্যু হয়।
প্রতিরোধের উপায়:
- জৈব নিরাপত্তা মেনে চলতে হবে।
- ডিম ফোটানোর জন্য সুস্থ, নিরোগ ও জীবাণু মুক্ত ডিম বেছে নিতে হবে।
- কোনো রূপ ধকল বা পীড়নে আক্রান্ত হওয়া মাত্র ভেট বেট পাউডার পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
চিকিৎসাঃ সিপ্রোফ্লক্স সলুশন ১ মিলি ১-২লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে । ডায়রিয়া হয় বিধায় খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হয় ।
(ঙ) ওফ্যালাইটিস/ন্যাভাল ইল (Neval III)
ওফ্যালাইটিস একটি ইসকারিসিয়া কলাই জীবাণুঘটিত রোগ তবে সংক্রামক নয়। ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে এ রোগটি মোরগ মুরগিকে আক্রমণ করে । ঘর বা লিটারের আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেলে, হ্যাচারির ইনকিউবেটরের মধ্যে আর্দ্রতা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে, কোনো কারণে বাচ্চা অবস্থায় মুরগির পেটে থাকা ডিমের কুসুম অব্যবহৃত থাকলে, বাচ্চা অবস্থায় জীবাণুর সংস্পর্শে আসলে ওফ্যালাইটিস রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা খুব বেশি বা কম হলে এবং পরিবহন জনিত পীড়নের কারণে মৃত্যু হার অধিক হয় ।
রোগের লক্ষণ:
- মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত মুরগির বাচ্চা সাধারণত সুস্থ দেখায়।
- অসুস্থ বাচ্চার ঝিমুনি হয় ও মাথা ঝুলে পড়ে।
- আলো-তাপের উৎসের দিকে জড়ো হয়ে থাকে ।
- নাভি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেটি লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। এ সময় সে স্থানে বাচ্চার ব্যাথা অনুভূত হয় ।
- জন্ম হতে ১০-১৫ দিন বয়স পর্যন্ত মৃত্যু হতে পারে। মৃত্যু হার ১৫% পর্যন্ত হয় ।
- বুকের চামড়ার নিচে ইডিমা (মাংস পেশিতে পচন ও পানি জমা) দেখা দিতে পারে ।
প্রতিরোধ
হ্যাচারির ইনকিউবেটরের মাধ্যমে আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে রোগের প্রতিরোধ ও বিস্তার রোধ করা সম্ভব। ইনকিউবেটরে পরিষ্কার ও ভালো ডিম বাহাই করতে বসাতে হবে।
চিকিৎসা: টেট্রা-ডেট পাউডার অথবা ডক্সাসিল-ডেট পাউডার নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে।
(চ) ফাউল কলেরা (Fowl Cholera)
হাঁস-মুরগির কলেরা বা ফাউল কলেরা হাসমুরগির ও অন্যান্য গৃহপালিত ও বন্য পাখির একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া জনিত সংক্রমক রোগ। উচ্চ হারে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার এবং ভাররিরা এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সব বয়সের পাখি এতে আক্রান্ত হতে পারে। হাঁসমুরগির ঘর স্বাস্থ্যসম্মত না হলে এবং ব্যবস্থাপনা ঘাটতি থাকলে এ রোগ মড়ক আকারে দেখা দেয়। সঠিকভাবে রোপ সনাক্ত করে চিকিৎসা করতে না পারলে মৃত্যু হার অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া এ রোগ একবার দেখা দিলে দমন করা মুশকিল হয়ে পড়ে। যদিও এ রোগকে ফাউল কলেরা বলে, কিন্তু ষ্টাভিয়ান পান্ডুরেপোসিস, অ্যাভিরাম হিমোরেজিক সেপ্টেলেমিরা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। তবে হাঁসের ক্ষেত্রে রোগকে হাঁসের কলেরা বা ডাক কলেরা বলা হয়।
মুরগির কলেরা রোগের কারণ:
পান্ডুরেলা মালটুসিডা নামক একপ্রকার গ্রাম নেগেটিভ ক্ষুদ্র দণ্ডাকৃতির বাইপোলার ব্যাকটেরিয়া এ রোগের একমাত্র কারণ।
মুরগির কলেরা রোগের সংক্রমণ :
মুরগির কলেরা রোগের রোগ নিম্নলিখিতভাবে সংক্রমিত হয় । যথা-
১. সংবেদনশীল মুরগির ঘরে কোনো বাহক মুরগি থাকলে বা প্রবেশ করলে।
২. বন্য পাখি বা অন্যান্য বাহক প্রাণির সংস্পর্শে সংবেদনশীল পাখি আসলে।
৩. একই ঘরের বা খামারের এক ঘর থেকে অন্য ঘরে নিম্নলিখিত ভাবে এ রোগ সংক্রমিত হয় । যথা-
ক. আক্রান্ত মুরগির নাকের সর্দির মাধ্যমে।
খ. এ রোগের মৃত মুরগিকে ঠোকর দিলে।
গ. কুলষিত পানির মাধ্যমে।
ঘ. মানুষের জামা জুতো ঘরের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, টিকা প্রদানের যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মাধ্যমে।
ঙ. কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে আক্রান্ত মোরগ থেকে সুস্থ মুরগিতে ।
মুরগি ও অন্যান্য পাখিতে সাধারনত দু'প্রকৃতিতে কলেরার লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন:
১. তীব্র প্রকৃতির লক্ষণ।
২. দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতির লক্ষণ ।
১. তীব্র প্রকৃতির লক্ষণঃ
ক. হঠাৎ ধপ করে পড়ে মারা যায়। রোগের লক্ষণ প্রকাশের পূর্বে অর্থাৎ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই মারা যায় ।
খ. সবুজ রংয়ের পাতলা বিষ্ঠা ত্যাগ করে । অনেক সময় বিষ্ঠা ফেনাযুক্ত হয়।
গ. নাক মুখ দিয়ে পানি পড়ে।
২. দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতির লক্ষণ:
ক. গলার ফুল ফুলে যায়। (বিশেষ করে মোরগের ক্ষেত্রে)।
খ. মাথার ঝুটি একেবারে কালো হয়ে যায় ।
গ. সন্ধিপ্ৰদাহ বা আৰ্দ্ৰাইটিস হয় এবং পা খোড়া হয়ে যায়।
ঘ. ডিমপাড়া মুরগির ডিম উৎপাদন কমে যায়। দুই মাস পর্যন্ত অসুস্থ থাকে।
ঙ. অবশেষে আস্তে আস্তে মারা যায়।
রোগ নির্নয়
নিম্নলিখিত ভাবে হাঁস-মুরগির কলেরা রোগ নির্ণয় করা যায় । যথা:
ক. রোগের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ দেখে।
খ. ময়নাতদন্তে বিভিন্ন অঙ্গের প্যাথলজিক্যাল পরিবর্তন দেখে। যথা:
১. অন্নের রক্তক্ষরণ
২. বন্ধুতে ছোট ছোট সাদা দাগ ।
৩. হৃদপিণ্ডের বাহিরের সাদা অংশে রক্তের ফোঁটা।
৪. মৃত মুরগির সমস্ত অঙ্গে রক্তক্ষরণ ও রক্তাধিক্য ।
৫. গবেষণাগারে জীবাণু কালচার করে ।
চিকিৎসা:
কলেরা রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক বা সালফোনেমাইট গ্রুপের ঔষধ উল্লেখিত মাত্রায় প্রয়োগ করে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়।
১.ফ্লুমেকুইন ১০% পাউডার ১গ্রাম/২ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৩-৫দিন আক্রান্ত পাখিকে পান করাতে হবে।
২. মেইন ২০% সলুশন ১ মিমি /৪ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৩-৫ দিন আক্রান্ত পাখিকে পান করাতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ
১) কলেরা রোগ প্রতিরোধে নিজের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে
ক) এই ভ্যাকসিন ৭৫দিন বয়সে ১ সি সি করে রানের মাংসে ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হয় ।
খ) প্রথম ভ্যাকসিন দেওয়ার ১৫ দিন পর পুনরায় ১ সি সি করে চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হয় ।
গ) তারপর ৬ মাস পরপর ১ সি সি করে চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হয় ।
২. সব সময় খামারের আশেপাশে জীবাণুনাশকের ব্যবহার বাড়ানো ।
৩. লোকজনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা।
৪. এক ঘরের যন্ত্রপাতি অন্য ঘরে নেয়ার সময় জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে জীবাণু মুক্ত করে নিতে হবে।
৫. খামারে জৈব নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে।
Read more